তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: বৌদ্ধদের অন্যতম সামাজিক, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালিত অনুষ্ঠান শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি বুধবার (১৩ জুলাই)। এই শুভানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা জীবনকে আরও সাবলীল, সুন্দর আর ঋদ্ধ করার প্রচেষ্টাকে ফের একবার নবায়ন করে থাকেন। শুধু সাধারণ বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরাই নয়, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্যও আষাঢ়ী পূর্ণিমা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন বহন করে। বৌদ্ধরা এদিনটিকে সচরাচর শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা হিসেবে অভিহিত করে থাকে।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের সময়ে আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিকে কেন্দ্র করে তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। এক আষাঢ়ে পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধ সিদ্ধার্থরূপে মাতৃগর্ভে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন। আরেক পূর্ণিমায় তিনি গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত ধারণ করেন এবং ছয় বছর কঠোর সাধনা করে মোক্ষ লাভ করেন। আর শেষে আরেক পূর্ণিমায় তিনি মহাঅনির্বাণ লাভ করেন।
এ ঘটনাগুলোকে উপলক্ষ করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা দিনটি পালন করে থাকেন। এ দিনটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই আষাঢ়ী পূর্ণিমার পরবর্তী তিন মাস বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বর্ষাবাস শুরু করেন। এ সময় ভিক্ষুরা জরুরি কোনো কারণ ছাড়া বিহারের বাইরে রাতযাপন করতে পারেন না। এই তিন মাস বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ধর্ম বিনয় অধ্যায়ন ও ধ্যান চর্চা করে থাকেন। এই তিন মাস বর্ষাবাস শেষ হওয়ার পর প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপনের মধ্য দিয়ে শুরু মাসব্যাপী কঠিন চীবরদানোৎসব।
জনশ্রুতি আছে, এক আষাঢ়ী পূর্ণিমায় রাজা শুদ্ধোধনের মহিষী রাণী মহামায়া উপোমথ ব্রত গ্রহণ করলেন। সে রাত্রে রাণী মহামায়া স্বপ্নমগ্না হয়ে দেখলেন যে চার দিক থেকে পাল দেবগণ এসে পালঙ্কসহ তাকে নিয়ে গেল হিমালয়ের পর্বতোপরি এক সমতল ভূমির ওপর। সেখানে মহামায়াকে সুউচ্চ এক মহাশাল বৃক্ষতলে রেখে দেবগণ সশ্রদ্ধ ভঙ্গিমায় এক পাশে অবস্থান দাঁড়িয়ে পড়ল। পরে দেবগণের মহিষীরা এসে মায়াদেবীকে হিমালয়ের মানস সরোবরে স্নান করিয়ে দিব্য বসন-ভূষণ ও মাল্যগন্ধে সাজিয়ে দিলেন। অনতিদূরে একটি শুভ্র রজতপর্বতে ছিল একটি সুবর্ণ প্রাসাদ। চারিদিক থেকে পাল দেবগণ মহারাজা পুনঃপালঙ্কসহ দেবীকে সেই প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে দিব্যশয্যায় শুইয়ে দিল। তখন অদূরবর্তী সুবর্ণ পর্বত থেকে এক শ্বেতহসত্মী নেমে এসে উত্তরদিক থেকে অগ্রসর হয়ে রজতপর্বতে আরোহণ করলেন। রজত শুভ্রশু একটি শ্বেতপদ্মের রূপ পরিগ্রহ করে কবীবর মহাক্রোষ্ণনাদে সুবর্ণ প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। তারপর ধীরে ধীরে তিনবার মাতৃশয্যা প্রদক্ষিণপূর্বক মায়ের শরীরের দক্ষিণ পার্শ্বভেদ করে মাতৃজঠরে প্রবেশ করলেন।
পর দিন প্রত্যুষে রাণী মহামায়া রাজা শুদ্ধোধনকে স্বপ্ন বৃত্তান্ত অবহিত করলেন। কালবিলম্ব না-করে রাজা শুদ্ধোধনকে চৌষট্টিজন জ্যোতির্বিদ এনে স্বপ্নের ফল জানতে চাইলেন। তারা বললেন, মহারাজ চিন্তা করবেন না, আপনার মহিষী সন্তানসম্ভবা। তিনি এমন এক পুত্ররত্ন লাভ করবেন যার ফলে বসুন্ধরা ধন্য হবে।
এক মহাগুণ-সমৃদ্ধ সন্তান লাভ করবেন, এ কথা শোনা মাত্রই রাজ্যময় জয়ধ্বনি দিতে শুরু করলেন। শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে শুভলগ্নে, শুভক্ষণে সিদ্ধার্থ ভূমিষ্ঠ হলেন নেপালের লুম্বিনী উদ্যানে। যথারীতি রাজকীয় সুখে দিনযাপনের মাধ্যমে বড় হতে লাগলেন এবং সব ধরনের বিদ্যাশিক্ষায় পারদর্শিতা অর্জন করলেন। সিদ্ধার্থ যৌবনে পদার্পণে রাজা শুদ্ধোধন ও রানী মহামায়া দেবীর সিদ্ধান্তক্রমে গোপাদেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। সংসার জীবনে ক্রমেই তার বৈরাগ্য জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলেন, মনের উদাসীনতা কাটাতে নগর ভ্রমণের ইচ্ছা পোষণ করলে রাজার নির্দেশক্রমে রাজকীয়ভাবে নগর ভ্রমণের ব্যবস্থা করলেন। অনাকাক্সিক্ষতভাবে দেখতে পেলেন নগরের চারদিক ভ্রমণে চারটি দৃশ্য, দৃশ্যগুলো যথাক্রমে জরাগ্রস্ত ব্যক্তি, ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি, মৃত ব্যক্তি ও সন্ন্যাসী। এতে তার মন আরও বেশি বিচলিত হয়ে উঠেছে।
সংবাদ পেলেন গোপাদেবীর সন্তান প্রসব হয়েছে, সন্তানের নাম রাখা হয়েছে ‘রাহুল’। সিদ্ধার্থ মনে মনে ভাবতে লাগলেন রাহুলের জন্ম হয়েছে, সংসার বন্ধন সুদৃঢ় হতে চলেছে, আষাঢ়ী পূর্ণিমা সমাগত, আর দেরি করা যাবে না। স্ত্রী-সন্তানকে এক পলক দেখে ছন্দককে ডেকে সেদিন রাতেই সিদ্ধার্থ বা গৌতম বুদ্ধ গৃহত্যাগ করলেন।