সাকিব আল হাসান, রৌমারী(কুড়িগ্রাম): ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারী বন্দরে’- পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের ভাওয়াইয়া সুরে যেখানে একদিন প্রাণের উৎসব হতো, সেখানে এখন শুধু ভাঙনের তাণ্ডব। সর্বগ্রাসী ব্রহ্মপুত্র গ্রাস করে চলেছে নতুন নতুন জনপদ, মানুষের স্বপ্ন-সাধ আর ভবিষ্যৎ। বৈরী নদ আর প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে গোটা জনপদ যেন পরাভূত। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার জনগোষ্ঠীর কেউ সব হারিয়ে রাস্তার পাশে, কেউবা ওয়াপদা বাঁধে কিংবা কুড়িগ্রাম চিলমারী পাকা রাস্তার দুই পাশে বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন।
প্রতিবছর ভাঙে চিলমারী। প্রতিবছরই মানুষ হারায় তাদের ভিটেমাটি, আশ্রয়। চিলমারীর ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে নয়ারহাট, অষ্টমীরচর ও চিলমারী ইউনিয়ন ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে পুরোপুরি বিলীন। বাকি রানীগঞ্জ ইউনিয়নের তিন চতুর্থাংশ, থানাহাট ইউনিয়নের অর্ধেক এবং রমনার অর্ধেক গিলে খেয়েছে ব্রহ্মপুত্র। প্রতি বর্ষা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্রের যা আগ্রাসী রূপ, হয়তো আর বেশি দেরি নেই চিলমারী উপজেলাই বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে যাবে।
চিলমারীর ওপর প্রথম আঘাতটা আসে ১৯৬৪ সালে। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী  সালামত হোসেন। তিনি বলেন, ‘দিনটি ছিল শনিবার। সারাদিনই থেমে থেমে বৃষ্টি। আমাদের বাড়ির পূর্বদিকে প্রায় ৪ একর জমির ওপর বাগান ছিল। প্রথমে সেখানেই হানা দেয় ব্রক্ষপুত্র। বাগানে দুই থেকে আড়াইশ’ বছরের পুরনো আম, জাম, বেল, কাঁঠালগাছ গুলো নদে একে একে ভেসে যায় চোখের সামনে। এই শোক নিয়ে সন্ধ্যায় সবাই নিজ নিজ ঘরে ঘুমাতে যাই। মা তখনও জেগে ছিলেন। তিনি হঠাৎ চিৎকার করে বলছিলেন, ওঠো সবাই, পালাও। ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে দেখি, পূর্বদিকের বৈঠকখানাটি নদে ভেসে যাচ্ছে। আর আমাদের বাড়িসহ পাশের কয়েকটি বাড়িতে বিশাল ফাটল ধরেছে। আমরা সবাই শুধু জীবন নিয়ে বাড়ির পশ্চিম পাশে নিরাপদ স্থানে পৌঁছতে সক্ষম হই। এর ৩০ মিনিটের ব্যবধানে আমাদের বাড়ি, ক্ষিতীশ চন্দ্র, একরাম আলী মণ্ডল ও জমিদার সুরেশ মল্লিকের বাড়ি নদে দেবে যায়। বাড়ি, জায়গা-জমি হারানোর শোকে বাবা হামিদ মিঞা ও বড় ভাই শারাফাত হোসেন অসুস্থ হয়ে পড়েন। বড় ভাই সুস্থ  হলেও বাবা আর বিছানা ছাড়েননি। তিন বছর অসুখে ভুগে ১৯৬৭  সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। পুরনো সেই কথা মনে করে আবেগে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে।
সালামত হোসেন আরও বলেন, ‘তখন মূল চিলমারী থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ছিল নদের অবস্থান। দু’দিনের মধ্যে বৈলমন্দিয়ার খাতা ও চিলমারীতে হানা দেয় ব্রহ্মপুত্র। চোখের সামনে ভেসে যায়  চিলমারী বন্দর, চিলমারী উচ্চ বিদ্যালয়, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়,  বড় বড় পাটের গোডাউন, থানা প্রশাসনের বিভিন্ন অফিস, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং ২০-২৫ হাজার লোকের জনবসতি। সেই যে চলছে, এখনও খিদে মেটেনি আগ্রাসী ব্রহ্মপুত্রের।’
প্রতিবছরই ভাঙছে নতুন নতুন জনপদ। চিলমারী উপজেলার চেয়ারম্যান শওকত আলী সরকার বীর বিক্রম বলেন, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি চিলমারীকে রক্ষার জন্য। আশা করছি সব সমস্যার সমাধান হবে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *