গত ঈদে অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের সময় বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার ছিল ১৫ শতাংশের আশেপাশে। সে সময়ে গড়ে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫০ থেকে ৬০ এর মধ্যে। তখন ঈদের ছুটিতে খুবই কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীও মাঠে নেমেছিল। আর বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা ৩০ শতাংশের আশেপাশে এবং মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ এর উপরে। অর্থাৎ গত ঈদের সময়ের চেয়ে বর্তমানে মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুণ, আক্রান্তের হার তিনগুনেরও বেশি। করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায়  বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম এবং মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় ৯ম।

রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীর জন্য নির্ধারিত  সুযোগ-সুবিধা ক্রমেই কমে আসছে। ইতিমধ্যে হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীর উপচে পড়া ভিড়। কোন হাসপাতালে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ICU বা উচ্চ চাপ সম্পন্ন অক্সিজেন সরবরাহ সুবিধাও শেষ পর্যায়ে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বলেছেন, আগত করোনা রোগীর অধিকাংশ ঢাকার বাইরে থেকে আসা। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন যেভাবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে একই হারে যদি আরও কিছুদিন করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে, সামনের দিনগুলোতে হাসপাতাসমূহের চিকিৎসকরা করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দিতে পারবে না।

এতো গেলো করোনা আক্রান্তদের পরিস্থিতি। কিন্তু করোনার এ বাড়তি চাপের কারণে অন্যান্য রোগে যারা আক্রান্ত তাদের চিকিৎসাও এখন কঠিন চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ করে যারা দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন, যেমন-ক্যান্সার, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং কিডনি জটিলতাসহ বিভিন্ন মারাত্মক ব্যাধিতে ভুগছেন, তাদের জন্য এখন হাসপাতালগুলো যেন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে যে, এই ধরনের রোগীরা করোনার ঝুঁকি নিয়েও হাসপাতালে যাচ্ছেন এবং সেখানে গিয়ে অনেকে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন।

আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়েছেন, তার বড় ভাই করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। বড় ভাবি করোনা আক্রান্ত হয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। ভাতিজা-ভাতিজি, নাতি-নাতনী সকলেই করোনা পজিটিভ আছেন। এমনকি ঐ বাসায় কাজের মেয়ে দুটিও করোনা পজিটিভ। উল্লেখ্য, প্রাথমিক পর্যায়ে বড় ভাই ছাড়া বাড়ির কেউই করোনা আক্রান্ত ছিলেন না। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা পারিবারিক দায়িত্ববোধ বা আবেগের বশবর্তী হয়ে স্বাস্থ্যবিধি লংঘন করে করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসার  কারনে বাড়ীর সকলেই করোনা পজিটিভ হয়েছেন।

অতিসম্প্রতি ৭১ টিভি চ্যানেলের সংবাদে একটি ভিডিও ফুটেজে প্রচারিত হয়েছে, শেরপুরের জনৈক আবদুস সোবহান করোনা আক্রান্ত হয়ে অক্সিজেনের মাত্রা ৬০ এ নীচে নেমে যাওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য অক্সিজেন সরবরাহ সুবিধাসহ একটি এম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। প্রথমেই গমন করেন মহাখালীস্থ ডিএনসিসি করোনা বিশেষায়িত হাসপাতালে। কিন্তু বিধি বাম, বেড খালি নাই। রোগীর স্বজনেরা এম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেও কোন ICU বেড পাননি। এমনকি অক্সিজেন সরবরাহ সুবিধাসহ কোন সাধারণ বেডও খালি  পাননি। এমনকি স্বজনেরা পরিচিত প্রভাবশালীজনদের দিয়েও চেষ্টা করিয়েছেন, কিছুতেই কিছু হলো না। কিন্তু এরই মধ্যে এম্বুলেন্সে রাখা সিলিন্ডারের সীমিত পরিমাণ অক্সিজেন নিঃশেষ হয়ে যায়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন তিনি। অক্সিজেনের অভাবেই এ পৃথিবীর আলো বাতাস ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন তিনি।
অপর একটি এম্বুলেন্স টাঙ্গাইল থেকে ৫৫ বছর বয়স্ক একজন মূমুর্ষ করোনা আক্রান্ত রোগী নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, করোনা আক্রান্ত রোগীটি ভর্তির জন্য চেষ্টা করতে হয়নি। পথিমধ্যে সিলিন্ডারের অক্সিজেন নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

এমনি পরিস্থিতিতে গত  বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১ থেকে করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার কর্তৃক আরোপিত সকল বিধিনিষেধ শিথিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করার পর, ঈদের আনন্দ পরিবারের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে বাড়ির পথে ছুটেছেন অনেক মানুষ। গত কয়েকদিনে যেভাবে মানুষ ঘরমুখে ফিরছে তাতে স্বাস্থ্যবিধি মানা আদৌ সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। আবার ইতিমধ্যে গরুর হাটও শুরু হয়েছে, সেখানেও স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই। এদিকে যানবাহনে মানা হচ্ছে না সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি। অর্ধেক যাত্রী ধারণের কথা থাকলেও অধিক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে। কেউ মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন বিশেষজ্ঞ বলছেন যে, এখন যেভাবে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে তাতে ঈদের পরে  আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার অনেক বাড়তে পারে। ফলে একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা তৈরি হতে পারে।

মানুষের জীবন-জীবিকা এবং ঈদ উৎসব উদযাপনের কথা বিবেচনা করেই সরকারকে এই ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এই সময়টা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরাও। তবে স্বস্থির বিষয় হলো, করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন করোনা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ থেকে কমে ১০ জনে এসেছে। বিনামূল্যে টিকা প্রদান কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। যদিও টীকা সংগ্রহকারীর সংখ্যা কম এবং টীকা নিতে ‘অনলাইন রেজিস্ট্রেশন‘ করার বিষয়টি বিড়ম্বনা মনে করেন সাধারণ মানুষেরা। এরই মাঝে টিকা প্রদানের বয়সসীমা ৪০ বছর থেকে নামিয়ে ৩০ বছর করা হয়েছে। বর্তমানে ১ কোটি ৮০ লক্ষ ডোজ টিকা মজুদ রয়েছে। আগামী ডিসেম্বর‘ ২০২১ নাগাদ আরও প্রায় ১০ কোটি ডোজ টিকা আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, দেশের প্রতিটি নাগরিককে বিনামূল্যে টিকা প্রদান নিশ্চিত করা হবে।

তবে সরকার যতই পদক্ষেপ গ্রহণ করুক না কেন, করোনা সংক্রমণ রোধে প্রয়োজন গনসচেতনতা। প্রয়োজন জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা ও সামাজিক উদ্যোগ। করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারের এতসব আয়োজনেও গনসচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে না। জনগনকে স্বাস্থবিধির গুরুত্ব অনুধাবন করানো যাচ্ছে না। মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপকারিতা বুঝানো যাচ্ছে না। শুধুমাত্র প্রশাসন ঘোষিত প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বিধিনিষেধ বা লকডাউন দিয়ে করোনা সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন লকডাউন চলতে থাকলে অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে পরার আশংকা রয়েছে। নিম্নআয়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবিকা বন্ধ হয়ে গেলে, সরকারের দৃষ্টির আড়ালে, অনাহারে মানুষ মরার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।

অনাহারে মানুষের জীবন হারানোর মত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটলে, অনেক বেশি রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে। সেকারনেই ভবিষ্যতের সংক্রমণের ভয়াবহতা বিবেচনায় রেখে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদপদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। রেডিও-টেলিভিশনে মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি মসজিদের ইমাম-খতিবগন, স্কুলের শিক্ষকমন্ডলী ও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে সক্রীয় করতে হবে। হালে করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারী কার্যক্রমে শুধুমাত্র সরকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়ায় জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের গুরুত্বহীন মনে করছেন। করোনা সংক্রমণ রোধে জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ততা অতীব জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সম্পৃক্ততা ছাড়া অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো দূরহ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অঙ্গুলি নির্দেশে বাঙালি জাতি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন করেছিল ও স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করে গণতন্ত্রের বিজয় এনেছিল। তাই রাজনৈতিক নেতৃত্বে প্রশাসনসহ সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ, মসজিদের ইমাম-খতিবগণ, শিক্ষকমন্ডলীসহ সকলস্তরের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। উপরোল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ এবং সামাজিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠনসমূহকে সম্পৃক্ত করে, জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে  মানুষকে মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব ও উপকারিতা অনুধাবন করানোর পাশাপাশি, টীকা গ্রহণে সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করাও জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা সংক্রমিত হোক বা না হোক, নাকমুখ ঢেকে যথাযথভাবে মাস্ক পরিধান করে  সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করলে ৯০-৯৫% সংক্রমণ প্রতিরোধ হয়।

এছাড়া পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য স্থাপিত অক্সিজেন উৎপাদন ব্যবস্থা জোরদার করে হাসপাতালসমূহে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করা বাধ্যতামূলক করতে হবে। অক্সিজেন ব্যবহার করতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি জরুরি ভিত্তিতে আমদানি করা প্রয়োজন। মার্চ ২০২০ থেকে করোনা মোকাবেলায় চিকিৎসক, পুলিশ, নার্সসহ অন্যান্য সম্মুখযোদ্ধারা অনেকেই ক্লান্ত। বিভিন্ন পেশার সহস্রাধিক সম্মুখযোদ্ধা  করোনা আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। চাহিদা অনুযায়ী ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনিশিয়ান এর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে  দ্রুত নতুন নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।

সর্বোপরি ‘মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে‘ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পুলিশ বাহিনী সহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী সকল বাহিনীকে যথাযথ দায়িত্ব দিতে হবে। কলকাতার পুলিশ শপিং মল, রাজপথ, যেকোন স্থানে মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে কঠোর কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। বর্তমানে কলকাতায় করোনা সংক্রমণের হার ০% এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশেও একইভাবে মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে পুলিশ বাহিনী সহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী সকল বাহিনীকে যথাযথ দায়িত্ব দিতে হবে।

আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে আমাদের সকলকে আরো সহযোগিতা করা খুবই জরুরি। মসজিদে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে মসজিদ পরিচালনা কমিটির প্রতি কঠোর নির্দেশ জারি করতে হবে। সরকারী-বেসরকারী অফিস, ব্যাংক, কলকারখানা, শপিংমল কাঁচাবাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্ব স্ব কর্তৃপক্ষ যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে। তবেই, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে।

ডঃ মোঃ আওলাদ হোসেন,

ভেটেরিনারীয়ান, পরিবেশবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মী ও কলামিস্ট,

ঢাকা, বাংলাদেশ। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *